উন্নত জাতের থাই কৈ মাছের চাষ

বর্তমানে বাংলাদেশে থাই কৈ মাছের সফলভাবে কৃত্রিমপ্রজনন ও প্রচুর পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। অধিক লাভজনক এবং দেশী কৈ মাছ অপেক্ষা অনেক বেশী উৎপাদন হওয়ায় বর্তমানে মৎস্য চাষীরা এই মাছ চাষে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছে। কৈ মাছের একটি নতুন আমদানিকৃত জাত (Strain) যা থাই কৈ নামে পরিচিত এবং এটি একটি জিওল মাছ হওয়ায় এরা সামান্য পানিতে অনেক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে। মাথা প্রায় ত্রিকোণাকৃতির। দেহ ফ্যাকাশে কালো ধরনের। রেনু পর্যায়- আর্টেমিয়া, জুপ্লাংটন, ক্ষুদ্র জলজ পোকামাকড় ইত্যাদি আকর্ষনীয় খাদ্য। জুভেনাইল পর্যায়- জুপ্লাংটন, ক্ষুদ্র জলজ পোকা, টিউবিফেক্স ওয়ার্ম ইত্যাদি এবং বয়োপ্রাপ্ত অবস্থায়-জলজ পোকামাকড়, বেন্থোস, টিউবিফেক্স, ক্ষুদ্র চিংড়ি, ডেট্রিটাস ও পঁচনরত প্রাণিজ দ্রব্যাদি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে থাকে।

থাই কৈ ও দেশী কৈ মাছের মধ্যে সাধারনত নিমোক্ত পার্থক্যগুলো সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়-
দেশী কৈথাই কৈ
তুলনামূলকভাবে ছোট, কম মাংসল ও লম্বাটে ধরনের।তুলনামূলকভাবে বড়, মাংসল ও প্রশস্ত ধরনের।
ছোট অবস্থায় কালচে ধরনের। পরিপক্ক অবস্থায় পিঠের দিকে বাদামী সবুজ এবং পেটের দিকে হালকা হলুদ রঙের হয়।দেহ দেশী কৈ মাছের তুলনায় ফ্যাকাশে ধরনের। দেহের উপরিভাগে ছোট ছোট কালো স্পট থাকে এবং পাখনাগুলো হালকা হলুদ ধরনের।
কানকোর পিছনে কালো দাগ থাকে কিন’ পুচ্ছ পাখনার গোড়ায় কালো দাগ থাকে না।কানকোর পিছনে ও পুচ্ছ পাখনার গোড়ায় কালো স্পট থাকে।
মুখ প্রান্তিক ও V আকৃতির।মুখ বড়, প্রশস্ত ও U আকৃতির।
কানকোর কাঁটা খুব শক্ত, অনিয়মিত এবং ধারালো।কানকোর কাঁটা তুলনামুলক ভাবে নরম, নিয়মিত এবং সুস্থ’ভাবে খাঁজকাঁটা।
অঙ্কীয় দিকে আঁইশের সজ্জা V আকৃতির।অঙ্কীয় দিকে আঁইশের সজ্জা U আকৃতির।


থাই কৈ মাছ চাষের গুরুত্বঃ
থাই কৈ অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মাছ। অসুস্ত ও রোগমুক্তির পর স্বাস্থ্যে ক্রমোন্নতির জন্য খাদ্য হিসেবে এটি একটি সমাদৃত মাছ হিসাবে পরিচিত। ইহা অধিক পরিমাণে ভিটামিন এ, খনিজ পদার্থ যেমন আয়রন ও কপার যা হিমোগ্লোবিন তৈরীর জন্য অত্যাবশ্যক, সহজে পাঁচনযোগ্য চর্বি এবং অনেক এমাইনো এসিড ধারণ করে। অতিরিক্ত শ্বসন অঙ্গ থাকায় এরা বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, ফলে জীবন- অবস্থায় বাজারজাত করা যায়। অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায় ফলে উৎপাদন দেশী কৈ অপেক্ষা অনেক বেশী। অন্যান্য মাছের তুলনায় চাহিদা ও বাজারমূল্য অনেক বেশী। সম্পুরক দানাদার খাদ্যে বর্ধন খুবই ভাল তাই এই মাছের চাষ অধিক লাভজনক। ব্যবস্থাপনার আওতায় আনলে ছোটবড় সব পুকুরেই থাই কৈ মাছ চাষ করা সম্ভব।
পুকুর নির্বাচনঃ 
পুকুর নির্বাচনের উপর থাই কৈ চাষের সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। পুকুর নির্বাচনের সময় যে সকল বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে তা হলো-
  • যে সমস্ত জমিতে বন্যার পানি প্রবেশ করে না কিন্তু পানি ধারন ক্ষমতা বেশী এইরূপ মাঝারী উঁচু জমি এলাকার জলাশয় কৈ চাষের জন্য উপযোগী।
  • সাধারনত দোঁআশ ও বেলে দোঁআশ মাটির পুকুর থাই কৈ চাষের জন্য বেশী উপযোগী।
  • ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য আয়তাকার ও ৪০-৬০ শতাংশের পুকুর হওয়া ভাল।
  • নার্সারী পুকুরের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • পুকুরের গভীরতা ৩-৫ ফুট হওয়া ভাল।
  • পানি পরিবর্তনের সুবিধা থাকা প্রয়োজন।
পুকুর প্রস্তুতিঃ
মজুদ পুকুর প্রস্তুতির সময় যে বিষয়গুলো অনুসরণ করা আবশ্যক তা হলো- পুকুর পাড় অবশ্যই ভালভাবে মেরামত করতে হবে। পুকুরের চারপাশে ১ মিটার উঁচু জাল দিয়ে ভালভাবে ঘিরে দিতে হবে। পুকুর পুরাতন হলে তলা ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে রোটেনন প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন, ৫-১০ কেজি হারে গোবর ছিটিয়ে মই দিতে হবে এবং এরপর পরিস্কার নলকূপের পানি ১.৫-২ ফুট পর্যন্ত দিতে হবে।
মজুদ পুকুরে পোনা মজুদঃ
নার্সারী পুকুরে পোনাগুলি ১ মাস প্রতিপালনের পর সাধারনতঃ ৫-৬ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। এ অবস্থায় এদেরকে মজুদ পুকুরে স্থানান্তর করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। মজুদকালীন সময়ে পোনা মৃত্যু হার কমানোর জন্য পোনা ছাড়ার পূর্বে ৩% লবন পানি দিয়ে গোছল করানোর পর ছাড়তে হবে এবং পরিবহণ জনিত কারনে ক্ষতরোগ দেখা দিলে শতাংশে প্রতি ১ কেজি হারে লবন পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুর প্রস্তুতির ৭-৮ দিন পর বড় পোনা স্থানান্তর করতে হবে। ব্যবস্থাপনার উপর মজুদ হার নির্ভর করে। প্রতি শতাংশে ১০০০-১২০০ পোনা মজুদ করা ভাল তবে পানি পরিবর্তনের সুবিধা থাকলে শতাংশ প্রতি ১৫০০ টি পর্যন্ত বড় পোনা মজুদ করা যায়। থাই কৈ মাছের সাথে কার্প জাতীয় মাছের চাষ করা যাবে না তবে শিং বা মাগুর চাষ করলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে দেশী মাগুর ২০টা শিং ১০টা মজুদ করা যেতে পারে।
খাদ্য প্রস্তুত ও প্রয়োগঃ
থাই কৈ মাছের নিয়মিত দৈহিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য সম্পুরক খাদ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাংখিত ফলাফল পাওয়ার জন্য কৈ মাছের খাদ্যে কমপক্ষে ৩৫% প্রোটিন থাকা আবশ্যক। বর্তমানে থাই কৈ মাছের জন্য তুলনামুলক ভাবে বেশী প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার বাজার জাত হচ্ছে। ভাল ফলাফল পাওয়ার লক্ষ্যে স্বনামধন্য স্পেকট্রা হেক্সা মেগা ফুড, আফতাব ফিশ ফিড, প্যরাগন ফিশ ফিড ইত্যাদি কোম্পানীর ভাসমান পিলেট খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভাসমান পিলেট খাদ্য প্রয়োগ করলে প্রয়োগকৃত খাদ্যের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হয় এবং পানির গুনাগুন সহজে নষ্ট হয় না। দুই ধরনের গবেষনায় দেখা গেছে ৫ সপ্তাহের পর থেকে ১০% দেহের ওজনের হারে খাবার দিলে ৭০-৭৫ দিনের মধ্যেই মাছের গড় ওজন ৭০ গ্রাম হয় কিন্তু এক্ষেত্রে FCR এর মান হয় ২.০-২.৫। 


অন্যদিকে ৫% হারে খাবার দিলে ৮ ওজনের হারে খাবার দেওয়াই উত্তম।
মজুদকালীর সময়ের উপর ভিত্তি করে খাদ্যের প্রকার ও প্রয়োগহার টেবিলের মাধ্যমে দেখানো হলো-
সময়                                খাবারের প্রকারপ্রয়োগহার % দৈহিক ওজন
১ম সপ্তাহষ্টাটার-১২০
২য় সপ্তাহষ্টাটার-১১৫
৩য় সপ্তাহষ্টাটার-১১০
৪র্থ সপ্তাহষ্টাটার-২১০
৫ম সপ্তাহ থেকে আহরন পর্যন্তগ্রোয়ার
মাছ আহরণ ও উৎপাদনঃ
সঠিক উপায়ে পরিচর্যা করলে ৯০ দিনের মধ্যেই থাই কৈ মাছ বাজারজাত করণের উপযোগী হয়। এ সময় থাই কৈ মাছ গড়ে ৬০-৭০ গ্রাম পর্যনৱ হয় এবং এদের বাঁচার হার ৬০-৭০% পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে। থাই কৈ মাছের গড় উৎপাদন ৪ মাসে প্রতি শতাংশে ৫০-৬০ কেজি পর্যন্ত আশা করা যায়।
চাষকালীন সময়ে কতিপয় গুরুত্বপূর্ন দিকঃ
স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও খাদ্য হার নির্নয়ের জন্য প্রতি ১০-১৫ দিন পরপর নমুনায়ন করা উচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নমুনায়নকৃত মাছগুলোকে পুকুরে ছেড়ে দিলে ক্ষত রোগ দেখা যায়। এক্ষেত্রে মাছগুলোকে পুকুরে ছাড়ার পূর্বে অবশ্যই ৩% লবন পানিতে গোছল করানো প্রয়োজন। অধিক প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার সরবরাহের ফলে পুকুরে ফাইটোপ্লাংটনের মাত্রারিক্ত অধিক্য দেখা যায় এই জন্য ১৫ দিন পরপর পুকুরের পানি আংশিক পরিবর্তন করা আবশ্যক। যে সমস্ত পুকুরে পানি পরিবর্তন করার সুবিধা থাকে না সে সমস্ত পুকুরে শ্রম পদ্ধতিতে এটি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ফাইটোপ্লাংটনের আবরন যে পাশে জমা হয় সেই পাশে পানি থেকে ১ফুট দুরে একটা গর্ত করতে হবে। পানি থেকে ৩-৪ ইঞ্চি গভীর নালা ঐ গর্তের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলে ফাইটোপ্লাংটনের আবরণ আপনা আপনি গর্তে জমা হয়। তখন এটা বালতি দিয়ে সেচে ফেলতে হবে।
শীতকালীন ব্যবস্থাপনাঃ
অধিকাংশ সময়ই শীতকালে থাই কৈ মাছে ক্ষতরোগ দেখা দেয়। এজন্য শীতকালের পূর্বেই যথাসম্ভব থাই কৈ মাছের বাজার জাত করা উত্তম। তবে পুকুরে যদি বাজারজাতকরনের অনুপযোগী মাছ থাকে তবে শীতকালে অবশ্যই যে সকল ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা উচিত তা হলো পুকুরের পানি সেচে ১.৫-২ ফুটের মধ্যে এনে শতাংশ প্রতি ৫০০ গ্রাম চুন পানিতে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিয়ে ২ ফুট পরিস্কার নলকুপের পানি যোগ করতে হবে। এর ২-৩ দিন পর প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে লবণ পানির সাথে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। সুযোগ থাকলে ১৫ দিন পরপর পানি পরিবর্তন করা আবশ্যক। মাছের ঘনত্ব কমিয়ে প্রতি শতাংশে ৫০০-৬০০ এর মধ্যে আনতে হবে। সর্বোচ্চ ০.৫-১% হারে খাবার দেয়া যেতে পারে এবং শীতকালে কোন অবস্থাতেই পুকুরে জাল টানা যাবে না।
সহলেখকঃ ড. মোঃ শরীফ উদ্দিন, সহকারী পরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।