শিং ও মাগুর মাছের আহরণ, বাজারজাতকরণ ও আর্থিক বিশ্লেষণ


মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ

মাছ আহরণঃ শিং ও মাগুর মাছ চাষের পদ্ধতি সঠিক ভাবে পরিচালিত হলে চাষের ১১০-১২০ দিনে মাছ বাজারজাতকরণের উপযোগি হয় এবং এ সময়ে শিং মাছের গড় ওজন ৭৫-১০০ গ্রাম ও মাগুর মাছের গড় ওজন ৯০-১১০ গ্রাম হয়ে থাকে। মাছের আকার ওজন, মাছের বাজার দর, চুরিসহ অন্যান্য ঝুঁকি এবং বিশেষ করে পুকুরে মাছের ধারণক্ষমতা (Carrying Capacity) বিবেচনায় রেখে মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাজারে বিক্রয়ের জন্য প্রেরিত মাছের গুণগতমান অধিক সময় ভাল রাখার জন্য মাছ আহরণের ১ দিন পূর্বে খাবার প্রয়োগ বন্ধ রাখা উচিত। মাছ চাষের পুকুরে অধিক ঘনত্বে মাছ থাকলে মাছ বাজারজাতকরণের পূর্বের দিন জাল টেনে মাছ ধরে ছেড়ে দিতে হবে, এর ফলে বাজারজাত করার সময় মাছের মৃত্যু হার কমে যায়।


মাছের মাছের বাজার দর বিভিন্ন এলাকায় ও ঋতুতে কম বেশি হয়ে থাকে। লাভজনক দামের প্রতি খেয়াল রেখে মাছ বাজারজাত করা উচিত। মাছের বাজার দর ভাল পাওয়ার জন্য মাছ ধরার আগেই দেশের বড় বাজারসমূহে যোগাযোগ স্থাপন করে বাজার দর যাচাই এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং বাজারসমূহে জীবন্ত মাছ ছোট বড় বাছাই করে (Grading) পাঠানোর ব্যবস্থা করা গেলে অধিক মূল্য পাওয়া যায়। 

আহরণ পূর্বে করণীয় কাজ

মাছ আহরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে নিচে উল্লেখিত বিয়ষসমূহ বিবেচনা করা প্রয়োজনঃ
  • বাজার দর যাচাই করা;
  • ক্রেতা নির্ধারণ করা;
  • জেলে ও জাল ঠিক করা;
  • পরিবহন ব্যবস্থা ঠিক করা;
  • পুকুরে বিদ্যমান জলজ আগাছা ও ডালপালা (যদি থাকে) অপসারণ করা;
  • মাছ পরিমাপের জন্য উপযুক্ত পরিমাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা করা;
  • মাছ জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করার জন্য কন্টেনার (ড্রাম) ব্যবস্থা করা;
  • মাছ আহরণ করে প্রাথমিক ভাবে জীবন্ত সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় নেটের হাপা সংগ্রহ করা;
  • মাছ প্যাকিং ও পরিবহনকালীন সংরক্ষণের জন্য পাত্র এবং বরফ সংগ্রহ করা।
  • মাছ আহরণের সময়

    ঠান্ডা এবং পরিষ্কার আবহাওয়ায় মাছ ধরা উচিত। বিশেষ করে নিকটবর্তী বাজারে পাঠানোর ক্ষেত্রে ভোরে এবং দূরবর্তী বাজারের জন্য মাঝ রাতে মাছ আহরণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারের উপযুক্ত সময়ের বেশি পূর্বে মাছ ধরে রাখা উচিত নয়।

    মাছ আহরণ পদ্ধতি

    পুকুরের আয়তন বা মাছ আহরণের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করেই আহরণ পদ্ধতি নির্বাচন করা যায়। মাছ প্রধানত তিনভাবে আহরণ করা যায়ঃ
    ক) বেড় জাল পদ্ধতিঃ যদি পুকুরের আয়তন বড় হয় এবং বেশি পরিমাণ মাছ বাজারজাত করতে হয় তাহলে বেড় জাল ব্যবহার করা উত্তম। এক্ষেত্রে বেড় জালের ফাঁসের আকার ১/৪ ইঞ্চি হওয়া উচিত। জালের প্রস্থ পানির গভীরতার দ্বিগুণ এবং পুকুরের দৈর্ঘ্যর দেড়গুণ হওয়া প্রয়োজন।
    খ) ঝাঁকি জাল পদ্ধতিঃ যদি কম পরিমাণ মাছ ধরতে হয় তাহলে ঝাঁকি জাল দ্বারা মাছ ধরা উচিত। মাছ ধরার ১০-১৫ মিনিট আগে কিছু খাবার দিলে মাছ ধরা সহজ হয়।
    গ) পানি নিষ্কাশন পদ্ধতিঃ বিশেষ করে সম্পূর্ণ আহরণের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। শিং ও মাগুর মাছ আহরণের সময় প্রাথমিকভাবে বেড় জাল দিয়ে অধিকাংশ মাছ ধরার পর, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে সম্পূর্ণ মাছ ধরতে হবে। পুকুর সেচে সম্পূর্ণ সহজে মাছ ধরার জন্য পুকুর প্রস্ত্ততের সময় পুকুরের এক দিকে ঢালু এবং মাঝ বরাবর পরিখা খনন করে রাখা উত্তম।

    মাছ আহরণ পরবর্তী কাজ

    পুকুর থেকে মাছ ধরার পর পরিস্কার পানি দ্বারা ধৌত করা শ্রেয়। শিং ও মাগুর স্বল্প অক্সিজেন মাত্রায় বেশ কিছু সময় বেঁচে থাকতে পারে তাই ধরার পর মাছের পরিমাপ করে প্লাষ্টিক ড্রামে পরিমাণমত পানিতে মাছ জিইয়ে পরিবহন ও বাজারজাত করা যেতে পারে। কাছে কিংবা দূরে সব বাজারে এভাবে মাছ পাঠালে মাছের গুণগতমান ভাল থাকে এবং অধিক মূল্যে বিক্রয় করা সম্ভব হয়।
    শিং ও মাগুর মাছ চাষের আর্থিক বিশ্লেষণ: 
    এক একরের একটি পুকুরে উপরে উল্লেখিত পদ্ধতিতে মাছ চাষে সম্ভাব্য উৎপাদন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব
    ক্রমিক নংবিবরণটাকার পরিমাণ
    ক)ব্যয়ের হিসাব
    ০১পুকুর সংস্কার/ভাড়া (৬ মাসের জন্য)১০,০০০.০০
    ০২শিং ও মাগুর মাছের পোনা ৬০,০০০টি (নার্সারিতে লালনের পর ৪০,০০০টি পোনা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা)১,২০,০০০.০০
    ০৩সিলভার/কাতল ১৫০টি১৫০০.০০
    ০৪চুন ২৫০ কেজি)২০০০.০০
    ০৫ইউরিয়া সার ৫০ কেজি৩৫০.০০
    ০৬টি এস পি সার ২৫ কেজি৩৫০.০০
    ০৭মাছের খাদ্য (প্রায় ৭০০০ কেজি)২,১০,০০০.০০
    ০৮পারিবারিক শ্রম ও শ্রমিক মজুরী২০,০০০.০০
    ০৯পরিবহন খরচ২০,০০০.০০
    ১০অন্যান্য খরচ১০,০০০.০০
    মোট খরচ (ক)৪,৫৮,৯০০.০০
    খ) আয়ের হিসাব
    ০১শিং ও মাগুর বিক্রয় (বাচার হার ৮০% এবং ১৫টিতে কেজি ধরে)৬,৪০,০০
    ০২সিলভার/কাতল মাছ বিক্রয় ২০০ কেজি (প্রায়)১১,০০০.০০
    মোট আয় (খ)৬,৫১,০০০.০০
    নিট লাভ =(খ-ক) = (৬,৫১,০০০.০০ - ৪,৪৫,৯০০.০০ = ২,০৫,১০০.০০

    উপসংহারঃ শিং, মাগুর, কৈ ইত্যাদি মাছ অত্যন্ত জনপ্রিয়, সু-স্বাদু ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু দেশীয় প্রজাতির এ মাছগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। এসব মাছের মধ্যে কৈ এবং শিং ইতোমধ্যে একক চাষ লাভজনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে মাগুর মাছ, কৈ ও পাংগাস মাছের সাথে সাথি ফসল হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং চাষের সম্প্রসারণও ঘটছে। শিং, মাগুর ও কৈ মাছের ন্যায় দেশীয় প্রজাতির অন্যান্য মাছ যেমন পাবদা, টেংরা, পুটি ইত্যাদি বিপন্ন প্রায় মাছ রক্ষার জন্য কেবল সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা নিলেই যথেষ্ট হবে না, কিভাবে অন্য প্রজাতির সাথে বাণিজ্যিকভাবে চাষের (Commercial Culture) অধিনে নেয়া যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই প্রকৃতপক্ষে এ সব মাছ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।