পেরিফাইটন : মাছ বাড়াবে দ্বিগুণ

তাওহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

মানুষের খাদ্য চাহিদা আর সরবরাহের মধ্যে মিল রাখার জন্য বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণা করে যাচ্ছেন। বিজ্ঞানীদের এ গবেষণা আর উদ্ভাবনের কারণেই বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র কিন্তু জনবহুল দেশগুলোর খাদ্য ঘাটতি মেটানো সম্ভব হচ্ছে। আমাদের দেশেরই তেমনি একটি উদ্ভাবন হলো পেরিফাইটন, যা মৎস্য উৎপাদনকে করেছে দুই থেকে তিনগুণ। অথচ খরচ খুবই কম। সাধারণ খামারিরা সহজেই এ পদ্ধতিতে চাষ করতে পারেন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। সহজ ও স্বল্প ব্যয়ের কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও নিচ্ছে দেশীয় উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তিটি। দীর্ঘ সময় আর অক্লান্ত পরিশ্রমে পেরিফাইন পদ্ধতিতে মৎস্য চাষের এ প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করেছেন দেশের খ্যাতনামা মৎস্যবিজ্ঞানী ও ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল ওহাব।

গবেষণার উদ্দেশ্য ও সূত্রপাত

এ দেশের গ্রামাঞ্চলে পুকুর বা নিচু যেসব জমি ধান চাষের অনুপযোগী সেসব পরিত্যক্ত জমিতে মাছ চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ দেশের বেশির ভাগ কৃষক বা খামারিই দরিদ্র হওয়ায় চাষকৃত মাছের খাদ্য সরবরাহ করতে প্রতিনিয়তই হিমশিম খেতে হয় তাঁদের। এ ছাড়া দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ক্রমান্বয়ে কৃষি জমি, পুকুর কিংবা জলাশয় ভরাট করে আবাসন গড়ে ওঠায় মাছ চাষের সম্ভাবনাও আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে মৎস্য উৎপাদন। তাই স্বল্পমূল্যে এবং অল্প জমিতে অধিক মৎস্য উৎপাদনের মাধ্যমে জনগণের মৎস্য আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে নিয়ে ১৯৯৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদে শুরু হয় গবেষণা। যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও ভারতীয় বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগে 'পেরিফাইটনভিত্তিক মাছ চাষ' প্রকল্পের আওতায় গবেষণা শুরুর দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর পর এ কাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. ওহাব।



পেরিফাইটন কী?


পেরিফাইটন একধরনের শৈবাল যা মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন জলজ জীব-অনুজীবের জটিল মিশ্রণ এ পেরিফাইটন, যা জলাশয়ের পানিতে অবস্থিত কোনো কিছুর গায়ে লেগে থাকে। এসব জীব-অনুজীবের মধ্যে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া, এককোষী প্রাণী, ছত্রাক, ফাইটোপ্লাংকটন, জুপ্লাংকটনসহ বিভিন্ন তলদেশীয় ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী। পেরিফাইটন বিভিন্ন মৎস্যকুলকে শুধু আকৃষ্টই করে না বরং এসব অনুজীব মাছ ও চিংড়ি জাতীয় প্রাণীর খুবই প্রিয় এবং পুষ্টিকর খাবারও বটে।

কোন মাছ এ পদ্ধতিতে চাষের উপযোগী

সাধারণত যেসব মাছ গ্রেজিং বা কোনো কিছুর সঙ্গে লেগে থাকা খাবার চেঁচে খায় সেসব মাছই পেরিফাইটন পদ্ধতিতে চাষের জন্য উপযোগী। দেশীয় ওই ধরনের মৎস্য প্রজাতির মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউসসহ তেলাপিয়া ও চিংড়ি পেরিফাইটন পদ্ধতিতে চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।

চাষ পদ্ধতি

পেরিফাইটন একধরনের শৈবাল হলেও সাধারণ পানিতে এবং সব পরিবেশে এটা জন্মায় না। সাবস্ট্রেট বা ভিত্তিমূলের ওপর পেরিফাইটন জন্মে থাকে। এ ক্ষেত্রে হিজল ডাল সবচেয়ে উপযোগী। তবে বাঁশ, কঞ্চি, শেওড়া ইত্যাদি গাছের ডাল এমনকি পাটের খড়ি, গ্লাস রড, প্লাস্টিক দণ্ডও ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব ডালপালা পুকুরজুড়ে বা ধান ক্ষেতের কোণে পুঁতে রাখলে তাতেই ওই শৈবালজাতীয় জুপ্লাংকটন বা ফাইটোপ্লাংকটন জন্মে থাকে এবং সবুজাভ রঙের একটি আস্তরণ পড়ে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রাণিজ খাবারও তৈরি হয়। ওই সব ডালপালার ওপর জন্মানো আস্তরণ বা শৈবালই পেরিফাইটন, যা মাছের প্রিয় খাবার। খাবার প্রয়োগের বাড়তি খরচ লাগে না বিধায় গরিব খামারিদের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। একই পুকুরে একই বাঁশ বা কঞ্চি প্রায় তিন বছর ব্যবহার করা যায়। এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে মাছের বৃদ্ধির তুলনায় পেরিফাইটন প্রযুক্তিটি অত্যন্ত পরিবেশবান্ধবও বটে।

পুষ্টিমান


পুকুরে বা ধানক্ষেতে পুঁতে রাখা গাছের ডালপালার ওপর জন্মানো পেরিফাইটনের পুষ্টিমান প্রচলিত পদ্ধতিতে মৎস্য খামারে প্রয়োগকৃত সার বা গৃহস্থালির কুঁড়াজাতীয় খাবারের তুলনায় প্রায় দুই থেকে তিনগুণ। সরবরাহকৃত খাদ্য ব্যবহার করে আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে রুই মাছের মনোকালচারের (এক প্রজাতির চাষ) ক্ষেত্রে উৎপাদন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি এক হাজার কেজি। অপরদিকে পেরিফাইটন পদ্ধতিতে একই পুকুরে ওই মাছের উৎপাদন হেক্টরপ্রতি এক হাজার ৯০০ কেজি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে পলিকালচার বা মিশ্রচাষের (একই সঙ্গে একাধিক প্রজাতির চাষ) ক্ষেত্রে পেরিফাইটন পদ্ধতিতে প্রায় তিনগুণ উৎপাদন পাওয়া গেছে। রুই-কাতলা মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে, রুই শতকরা ৬০ ভাগ ও কাতলা শতকরা ৪০ ভাগ হওয়া ভালো। এ ছাড়া তেলাপিয়া-চিংড়ি মিশ্রচাষে ১৪৫ দিনে সর্বোচ্চ মোট উৎপাদন হেক্টরপ্রতি দুই হাজার ৪৪৫ কেজি তেলাপিয়া এবং ১৪১ কেজি চিংড়ি পাওয়া গেছে।

সম্ভাবনা ও গবেষকের কথা

পরিবেশবান্ধব, ব্যয়স্বল্পতা এবং সহজে সম্পাদনযোগ্য প্রযুক্তিটি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বর্তমানে বিদেশের মাটিতেও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, হাইতি, ইসরায়েল, ঘানাসহ বেশ কয়েকটি দেশে পরীক্ষামূলক ব্যবহারও চলছে। গবেষণার শুরু থেকে ইতিমধ্যেই এই গবেষণায় পাঁচজন পিএইচডি ও ২০ জন এমএস শিক্ষার্থী ডিগ্রি লাভ করেছেন। এখনো এ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালু রয়েছে। তবে সমপ্রসারণ সুবিধার অভাবে দেশের অনেক স্থানেই যথেষ্ট সম্ভাবনাময় এ প্রযুক্তিটির ব্যবহার জানেন না অনেক খামারি। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সক্রিয় ভূমিকা রাখা দরকার বলে মনে করেন ড. ওহাব। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে সাধারণত গৃহস্থালি পুকুরগুলো এমনিতেই ফেলে রাখা হয়। সেখানে মাছ ছাড়া হলেও মাছের বৃদ্ধি হয় খুবই কম। এ ক্ষেত্রে পেরিফাইটন পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে সহজেই মাছের উৎপাদন বাড়ানো তথা বর্ধিত জনসংখ্যার মৎস্য আমিষের চাহিদা অনেকাংশেই পূরণ করা সম্ভব।'

5 comments:

R. K. Khan said... Udyokta

ei poddhoti ki koi mas chas er khetre proyog kora jay?

R. K. Khan said... Udyokta

এই পদ্ধতি কি কৈ মাছ চাষে ব্যাবহার করা যাবে?

Badal said... Udyokta

কৈ মাছের জন্য প্রযোজ্য নয়।

Unknown said... Udyokta

where i can get the periphyton,let me know pleas.

Badal said... Udyokta

পেরিফাইটন নিজে তৈরী করতে হয়। বাঁশ বা অন্যকোন গাছের কঞ্জি দিয়ে।