শামুক চাষ একটি লাভ জনক ব্যবসা

আমাদের খাল-বিলে, আনাচে-কানাচে, অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা দেশীয় ছোট শামুকের চাষ খুলে দিতে পারে বানিজ্যিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। দেশে চাকরীর বাজারে যখন সঙ্কট তখন নিশ্চিত আয়ের উৎস হিসেবে শামুক চাষ করে দেশে বিক্রি ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শামুক রপ্তানি করে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে বেকার জনগোষ্ঠী স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে নিজেদেরকে। মাছের খাদ্য তৈরিতে শামুক ব্যবহার হয়ে থাকে। মৎস্য চাষে প্রাণিজ প্রোটিন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। সে জন্য বিদেশ থেকে মিট অ্যান্ড বোন আমদানি করতে প্রচুর অর্থ খরচ হয়। কিন্তু দেশীয় শামুক দ্বারা মৎস্য খাদ্য তৈরি করলে খরচও অনেক কম পড়ে। সেই সঙ্গে পুষ্টিগুণও ঠিক থাকে। পাশাপাশি দেশীয় সম্পদও রক্ষা হয়। দেশি জাতের শামুক চাষ মৎস খাদ্যের উপজাত মিট এন্ড বোনএর আমদানি নির্ভরতা কমাতে পারে। দেশি প্রজাতির আপেল শামুক চাষ করে ইতিমধ্যে অনেকে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনও করেছেন। তাছাড়া হাঁসের খামারে সরাসরি শামুক খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যায় ফলে এর বাজার কিন্তু ছোট নয়।


শিক্ষিত যুবকরা মাছ চাষে জড়িত হলে শুধু যে বেকার সমস্যার সমাধান হয় তা-ই নয়, চাষাবাদ পদ্ধতিরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। তেমনই এক পরিবর্তনের সূচনা করেছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার সত্রাশিয়া এলাকার আবু রেজা মাহবুবুল হক শাহীন (৫০)। মাছ চাষে তিনি শুরু করেছেন শামুকের ব্যবহার।

নিজ খামারেই তিনি শামুক থেকে মাছের খাদ্য তৈরি করছেন। এতে তাঁর বাজারজাত মৎস্য খাদ্য ব্যবহারের পরিমাণ কমেছে। ফলে মাছ চাষের ব্যয়ও কমে এসেছে। এ ছাড়া শামুকের তৈরি খাবার খাওয়ানোয় মাছের স্বাদও ভালো বলে মাহবুবুল হক জানান। কোনো কোনো মাছ চাষি মাহবুবুল হকের কাছে জানার পর নিজেদের খামারেও এ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা মাছ চাষে শামুকের ব্যাপক ব্যবহারকে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব বলে মন্তব্য করেছেন। এ ছাড়া মাছ চাষে শামুকের তৈরি খাবার ব্যবহার বাড়লে দেশে 'মিট অ্যান্ড বোন'-এর আমদানি অনেকাংশে কমে যাবে, যা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

কাকতলীয় ঘটনার মধ্য দিয়েই যেমন বড় বড় ঘটনা বা কাহিনীর সূত্রপাত, ময়মনসিংহের মাহবুবুল হক শাহীনের ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনি। মাহবুবুল হক শাহীনের মাছ চাষি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তিনি ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে অনার্স করেন। ১৯৯১-এর দিকে ফ্রান্সে চলে যান। কিন্তু ২০০৫-এ আবার দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে নিজ এলাকা মুক্তাগাছায় চাচা এম এ সোবহানের মাছের খামারে যুক্ত হন। শুরু করেন শিং, মাগুর, কৈ, পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া মাছের চাষ। শিক্ষিত যুবক হলেও একজন পরিশ্রমী মানুষ হিসেবে দিনভর কাদা-পানিতে মাখামাখি করে সাফল্যস্বরূপ প্রথম বছরই মাছ চাষে আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ লাভ করেন।

মাছ চাষের সময়ই মাহবুবুল হক শাহীন খেয়াল করেন, একটি পুকুরের পাঙ্গাশ মাছ বেশ পুষ্ট হয়েছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি মাছের পেটে পেলেন শামুক। এ ঘটনাটি মাহবুবুল হক শাহীনকে নতুন করে ভাবায়। তিনি খালবিল থেকে শামুক সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট একটি পুকুরে চাষ শুরু করেন। যোগাযোগ করেন মৎস্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। শামুক চাষে তিনি সফল হন। এরপর সফল হন শামুক থেকে মাছের খাদ্য তৈরিতেও। মাহবুবুল হক শাহীন বলেন, তাঁর খামারে মাছের খাবারের প্রায় ৪০ ভাগ এখন তিনি শামুক থেকে তৈরি করছেন। গত বছর তিনি শামুক থেকে খাদ্য তৈরি করেছিলেন চার টন। এবার তাঁর লক্ষ্যমাত্রা আট টন। মাহবুবুল হক শাহীন বলেন, তাঁর নিজের পুকুরের শামুক থেকে যে খাবার তৈরি হয়, এটি তাঁর নিজের খামারেই প্রয়োজন পড়ে। তবে তিনি প্রান্তিক অনেক মাছ চাষিকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছেন। নিবেদিতপ্রাণ মাছ চাষি মাহবুবুল হক শাহীন দিন-রাত মাছ চাষ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি তাঁর নিজের মেধা আর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে মাছ চাষে বিভিন্ন ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করছেন।


যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সম্ভাবনাময় এ খাতটি বেকারত্ব লাঘব ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে সহায়ক হবে বলে আমার ধারণা।

তিনি বলেন, একজন মাছ চাষি তাঁর ক্ষুদ্র প্রযুক্তির ব্যবহার করে শামুক থেকে মাছের অন্যতম উপকরণ প্রোটিন উৎপাদন করতে পারে। মাছ চাষির উৎপাদিত প্রোটিনে কোনো রাসায়নিক প্রভাব থাকার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আমাদের দেশে মাছ চাষে প্রোটিনের উৎস হিসেবে যে শুঁটকি ব্যবহার করা হয়, তা সংরক্ষণের জন্য প্রচুর পরিমাণে নিষিদ্ধ রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তবে শামুকে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে না। তাঁর ভাষায়, 'সুস্বাস্থ্যের জন্য' শামুক চাষে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
তিনি বলেন, কুড়া, খৈল, শামুকের গুঁড়ো, ভিটামিন, লবণ শ্রমিক ও মেশিন চার্জ মিলিয়ে শামুক দিয়ে তৈরি এক কেজি মাছের খাবারের মূল্য সাড়ে ১১ টাকার মতো। অথচ বাজারে মাছের খাবারের মূল্য প্রতি কেজি ১৮ থেকে ২০ টাকা। শামুক চাষ সম্পর্কে মাহবুবুল হক শাহীন বলেন, ৪০-৪৫ দিনে ১২০ শতাংশ পুকুর থেকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় দুই হাজার কেজি শামুক আহরণ সম্ভব। প্রতি কেজি শামুকের গড় উৎপাদন ব্যয় হয় মাত্র পাঁচ টাকা মতো।


মাহবুবুল হক শাহীন বলেন, বাংলাদেশে ছোট দেশীয় শামুক চাষ সম্প্রসারণ ও সঠিক বাজারজাতকরণের মধ্য দিয়ে মাছ সম্পদের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। এতে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মিট অ্যান্ড বোনের ওপর চাপ কমবে। বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। তিনি এ বিষয়টি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

মৎস্য বিজ্ঞানী বললেন
মাহবুবুল হক শাহীনের শামুক চাষ এবং এর থেকে মাছের খাবার তৈরির পুরো প্রক্রিয়ায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহফুজুল হক রিপন। তিনি বলেন, পুকুরে শামুক চাষ এবং তা থেকে খাবার তৈরি করে মাহবুবুল হক শাহীন সাফল্য পেয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন শামুক থেকে খাদ্য তৈরি করলে মাছের খাবার বাবদ ব্যয় প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। তিনি বলেন, যদি মাছ চাষে ব্যাপকভাবে শামুকের তৈরি খাবার ব্যবহার করা হয়, তাহলে বিদেশ থেকে মাছের খাদ্য 'মিট অ্যান্ড বোন' আমদানি অনেকাংশে কমে যাবে। এতে দেশের লাভ, চাষির লাভ। ড. মাহফুজুল হক রিপন বলেন, তাঁর ধারণা, শামুক থেকে উৎপাদিত খাদ্য মাছ বেশি খায়। কারণ এ খাবার অনেকটাই প্রাকৃতিক। এতে মাছ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধিও পায় বেশি। এ ছাড়া শামুকের তৈরি খাবার খাওয়া মাছ স্বাদেও অনেকটা ভালো হয় বলে তিনি জানান। ড. মাহফুজুল হক রিপন আরো বলেন, দেশে চাষি পর্যায়ে শামুক চাষ কতটুকু সম্ভব, এর সমস্যা এবং সম্ভাবনাগুলো কী কী-সেটি বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই একটি পুকুরে শামুক চাষ করে গবেষণা করছেন। এ বছরের শেষ দিকে এ গবেষণার ফলাফল পাওয়া যাবে।

চাষ কৌশল
১২০ শতাংশের পুকুরে প্রতি শতাংশ হিসেবে এক কেজি গোবর, এক কেজি খৈল ও ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া পানিতে ভালোভাবে মেশাতে হবে। এ মিশ্রণ সমান চার ভাগে ভাগ করে তিন দিন অন্তর পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরের পানির রং যখন গাঢ় সবুজ হবে, তখন বুঝতে হবে পুকুরটি শামুক চাষের উপযোগী হয়েছে। এরপর খালবিল বা পুকুর থেকে শামুক সংগ্রহ করে প্রতি শতাংশ হিসেবে ২৫০ গ্রাম শামুক পুকুরের চারদিকে ছিটিয়ে দিতে হবে। পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে শামুক ব্যাপকভাবে বংশবিস্তার করবে। এরপর ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ শামুক পাওয়া যাবে। অর্থাৎ ১২০ শতাংশ পুকুর থেকে ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে প্রায় দুই হাজার কেজি ছোট শামুক উৎপাদন সম্ভব। শামুকের খাবার হিসেবে প্রতি শতাংশ হিসেবে ২৫০ গ্রাম গোবর, ২৫০ গ্রাম খৈল এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মেশানো কম্পোস্ট তিন দিন পরপর পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুর থেকে শামুক তুলে চালের কুড়ার সঙ্গে মিশিয়ে তাজা শামুককে প্রথমে খাদ্য ভাঙানোর পিলেট মেশিনের মাধ্যমে গুঁড়ো করা হয়। এগুলো পরে রোদে শুকানোর পর খৈল ভাঙানোর মেশিনের মাধ্যমে আবার সূক্ষ্মভাবে চূর্ণ করে সরাসরি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

পুকুর থেকে শামুক তুলে চালের কুড়ার সঙ্গে মিশিয়ে তাজা শামুককে প্রথমে খাদ্য ভাঙানোর পিলেট মেশিনের মাধ্যমে গুঁড়ো করা হয়। এগুলো পরে রোদে শুকানোর পর খৈল ভাঙানোর মেশিনের মাধ্যমে আবার সূক্ষ্মভাবে চূর্ণ করে সরাসরি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পরে তা পাঙ্গাসশিংমাগুরকৈতেলাপিয়াসহ অন্যান্য মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতে বাজারে প্রচলিত খাদ্যের চেয়ে অর্ধেকেরও কম খরচ হওয়ায় লাভ বেশি হয়। শামুক আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের একটি প্রিয় খাবার। এছাড়া শামুকের প্রজনন ক্ষমতা বেশি হওয়ায় তা বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করা যায়। বাজার সৃষ্টি করতে পারলে বাণিজ্যিকভাবে শামুক চাষ করে প্রচুর টাকা আয় করা সম্ভব। শামুক চাষে কম পুঁজি লাগে বলে সহজেই করা সম্ভব। শুঁটকি মাছ ব্যবহার করে মৎস্য খাদ্য তৈরি করলে তা সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা শামুকের তৈরি খাদ্যে এ আশঙ্কা নেই বললেই চলে। শামুক দিয়ে মাছের খাবার তৈরি একটি ভালো পদ্ধতি। এটিকে আরও সম্প্রসারণ করা দরকার। অন্যদিকে মাছ চাষে শামুকের ব্যাপক ব্যবহার যেমন সাশ্রয়ী তেমনি পরিবেশবান্ধব। শামুক চাষ সম্প্রসারণ ও সঠিক বাজারজাতকরণের মধ্য দিয়ে মাছ চাষে বিভিন্ন ইতিবাচক পরিবর্তন ও মাছ সম্পদের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। শামুক থেকে উৎপাদিত খাদ্য মাছ বেশি খায় কারণ এ খাবার অনেকটাই প্রাকৃতিক। এতে মাছ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধিও পায় বেশি। সংগৃহীত শামুকের খোলসের মধ্যের নরম অংশ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চিংড়ি ঘেরে মাছের প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা। তৈরি ফিস ফিড অপেক্ষা শামুক সুলভ ও মাছের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক।
লেখক: নিয়ামুল কবীর সজল

3 comments:

Unknown said... Udyokta

GREET SYSTEM

Abdul mojid said... Udyokta

চমৎকার তথ্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি জনাব মাহবুবুল হক শাহীন সাহেবএর সাথে যোগাযোগ করলে উপকৃত হব, উনার ফোন নাম্বার এর ব্যবস্থা করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।

Unknown said... Udyokta

ami kivabe samuk chas er prosikhon nite pari? mahbubul haw sahin vai er contact no. doya kore dite parben apni....mahmud,Dhaka