এ্যাকুয়ারিয়ামে গোল্ড ফিশের প্রজনন


ব্রুড গোল্ড ফিশ পুরুষ ও স্ত্রী গোল্ড ফিশ একটি অতি পরিচিত বিদেশী বাহারি মাছ। বাসায় এ্যাকুয়ারিয়ামে খুব সহজেই যেমন একে লালন-পালন করা যায় তেমনই সহজেই এর প্রজননও করা যায়। লালন-পালনের পাশাপাশি প্রজনন করানোর মাধ্যমে ঘরের সৌন্দর্য ও আয় দুই সম্ভব।  গোল্ড ফিশ মূলত পুকুর, ডোবা, হ্রদ ও কম প্রবাহ বিশিষ্ট নদী ও খাল যেখানে জলজ উদ্ভিদ রয়েছে এমন পরিবেশে বাস করে। প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রধানত প্ল্যাঙ্কটন, বেন্থোস, উদ্ভিদাংশ এবং ডেট্রিটাস খেয়ে থাকে। গোল্ড ফিশ নানা ধরণের- কমেট, ফানটেল, লায়ন হেড, ওরান্ডা, পার্ল-স্কেল, পমপম, রাইকিন, সুবুনকিন, টেলিস্কোপ, রানচু, পাণ্ডা, ভেইলটেল, বাটারফ্লাইটেল ইত্যাদি। 


বর্তমানে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশী লালন-পালনকৃত বাহারি মাছের মধ্যে গোল্ড ফিশ অন্যতম। বলা যায় এ্যাকুয়ারিয়ামে কৃত্রিম প্যাকেট-জাত খাবারে অভ্যস্ত এই মাছের লালন-পালন অত্যন্ত সহজ বিধায় সৌখিন মাছ লালন-পালনকারীর হাতেখড়ি হয় এই মাছের মাধ্যমেই।  



গোল্ড ফিশের শ্রেণীতাত্ত্বিক অবস্থান: Class: Osteichthyes Sub-Class: Actinopterygii Order: Cypriniformes Sub-Order: Cyprinoidei Family: Cyprinidae Genus: Carassius Species: Carassius auratus 



প্রজননের সময়, বয়স ও তাপমাত্রা:  তাপমাত্রা অনুকূলে থাকলে গোল্ড ফিশ যে কোন সময়ই ডিম দেয়। সাধারণত ৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা এদের প্রজননের জন্য প্রয়োজন। বাংলাদেশের তাপমাত্রায় মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনায়াসে ডিম দেয়। বেশী শীতে ডিম দিলেও শীতের তীব্রতার জন্য পোনা বাঁচানো কঠিন হয়ে পরে। গোল্ড ফিশের বৃদ্ধির জন্য ৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার প্রয়োজন। দেড় থেকে দুই বছর বয়সে গোল্ড ফিশ প্রজননের জন্য উপযুক্ত হয়ে থাকে।  



স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সনাক্তকরণ: ছোট মাছের ক্ষেত্রে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সনাক্ত করা খুব কঠিন কিন্তু বয়স্ক মাছ থেকে সহজেই স্ত্রী,পুরুষ আলাদা করা সম্ভব।  পেটে ডিম আসলে স্ত্রী মাছের পেট অনেক নরম ও ফোলা থাকে। অপরদিকে পুরুষ মাছের ক্ষেত্রে পেট স্ত্রী মাছের তুলনায় শক্ত হয় পুরুষ মাছের জেনিটাল ওপেনিং স্ত্রী মাছের চেয়ে তুলনামূলক বেশী সাদাটে হয়। স্ত্রীদের পেক্টোরাল ফিন অনেক নরম হয় কিন্তু পুরুষদের পেক্টোরাল ফিন ঘস-ঘসে হয়। প্রজনের পূর্বে মাছের পেটে চাপ দিলে জেনিটাল ওপেনিং দিয়ে স্ত্রী মাছের ক্ষেত্রে ডিম ও পুরুষ মাছের ক্ষেত্রে শুক্রাণু বের হয়ে আসে। তবে এ প্রক্রিয়াটি উভয় মাছের জন্যই ক্ষতিকর। এছাড়াও এই মাছের আচরন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও খুব সহজেই স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা করা সম্ভব। একটি এ্যাকুয়ারিয়ামে পানি দিয়ে তাতে কিছু মাছ ছেড়ে দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর স্ত্রী মাছকে পুরুষ মাছ তাড়া করবে। এ থেকে সহজেই স্ত্রী ও পুরুষ মাছ আলাদা করা যায়। 



প্রজননের জন্য এ্যাকুয়ারিয়াম প্রস্তুতি:  এক জোড়া ৪-৫ ইঞ্চির গোল্ড ফিশ কে সহজেই ১৫ ইঞ্চি প্রস্থ, ১৫ ইঞ্চি উচ্চতা ও ২৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এ্যাকুয়ারিয়ামে প্রজনন করানো যায়।  যে এ্যাকুয়ারিয়ামে প্রজনন করানো হবে তাতে ফিল্টার না দেওয়াই ভালো। ফিল্টার পানিকে নিচ থেকে উপড়ে উঠায়। এ ক্ষেত্রে ডিম ফুটে পোনা হলে পানির টানে পোনাও পাথরের নিচে চলে যায়। পানির অক্সিজেন ঘাটতি পূরণের জন্য এয়ারেটর এর ব্যবস্থা করা যায়।  স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছই নিষিক্ত ডিম খেয়ে ফেলে। সে জন্যে ডিম থেকে স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছকেই আলাদা রাখতে হয়। এজন্য বিভিন্ন পদ্ধতি নেয়া হয়ে থাকে। যেমন-  এ্যাকুয়ারিয়ামে মার্বেল দিলে ডিম মার্বেলের ফাঁকে চলে যায় ও নিরাপদ থাকে।  অনেকে প্রজননের জন্য ব্রিডিং মেট ব্যাবহার করে থাকেন। এটি কার্পেটের মত এবং এ্যাকুয়ারিয়ামের ফ্লোরে স্থাপন করা হয়। ডিম নিষিক্ত হবার পর মেটটি তুলে অন্য একটি এ্যাকুয়ারিয়ামে তা স্থাপন করতে হবে। সেই এ্যাকুয়ারিয়ামে নতুন একটি মেট স্থাপন করে নতুন আরেক জোড়ার প্রজনন করানো যায়।  এছাড়াও ডিম থেকে মাছকে আলাদা রাখার একটি সহজ পদ্ধতি হচ্ছে প্রজনন বাক্স ব্যবহার করা। প্রজনন বাক্স ব্যবহার অপেক্ষাকৃত সহজ ও কম ব্যয় সাপেক্ষ। এর জন্য প্রয়োজন কয়েকটি নেটের শপিং ব্যাগ ও মোটা তার। নেটের শপিং ব্যাগের পরিবর্তে মশারীর নেটও ব্যবহার করা যেতে পারে। যাই হোক প্রথমে এ্যাকুয়ারিয়ামের মাপের চেয়ে সামান্য ছোট আকারের একটি বাক্স আকৃতির ফ্রেম তার দিয়ে তৈরি করতে হবে। এরপর এই ফ্রেমের চারিদিকে নেটের শপিং ব্যাগের নেট ব্যবহার করে আটকে দিতে হবে। ব্যাস হয়ে গেল প্রজনন বাক্স।  প্রজনন বাক্সটির তলদেশ এ্যাকুয়ারিয়ামের মেঝে থেকে কমপক্ষে ৩-৪ ইঞ্চি উপরে স্থাপন করতে হবে। যেন কোন অবস্থাতেই মাছ এ্যাকুয়ারিয়ামের মেঝের নাগাল না পায় এবং ডিম নষ্ট না করে।   



প্রজনন:  একটি এ্যাকুয়ারিয়ামে প্রজনন বাক্সটি স্থাপন করার পর সুস্থ, স্বাভাবিক পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে রাতে ঐ প্রজনন বাক্সে ছেড়ে দিতে হবে। এর ফলে মাছের ডিম প্রজনন বাক্সের জালের ফাকা দিয়ে বের হয়ে নিচে পরবে। ফলে মাছ আর ডিম নষ্ট করতে পারবে না।  মাছ ছাড়ার পূর্বে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যে এ্যাকুয়ারিয়ামে মাছকে পরিচর্যা করা হয়েছে সেই পানির তাপমাত্রা ও প্রজনন এ্যাকুয়ারিয়ামের পানির তাপমাত্রা যেন একই রকম অর্থাৎ কাছাকাছি হয়। মাছ ছাড়ার পর সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে।  কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরুষ মাছটি স্ত্রী মাছকে তাড়া করবে এবং মাথা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত এবডোমেন বা উদরে আঘাত করবে। এর ফলশ্রুতিতে এক সময় স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটা পর্যায়ে ডিম ছেড়ে দেবে। প্রজননে অংশ নেয়া পুরুষ মাছও প্রায় সাথে সাথেই শুক্রাণু ছাড়বে। ফলে গোল্ড ফিশের ডিম নিষিক্ত হয় দেহের বাইরে। স্ত্রী বা পুরুষ কোন মাছেরই প্যারেন্টাল কেয়ার দেখতে পাওয়া যায় না বরং এরা নিষিক্ত ডিম খেয়ে ফেলে। তাই ডিম নিষিক্ত হবার পরপরই উভয় মাছকেই সরিয়ে ফেলতে হবে। নেটের প্রজনন বাক্স ব্যবহার করার পরও এটি করতে হয় কারণ নেটের গায়েও কিছু নিষিক্ত ডিম লেগে থাকে যা প্রজননে অংশ নেয়া মাছ নষ্ট করতে পারে।  সাধারণত ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যেই ডিম নিষিক্ত হয়ে যায়।  প্রজনন ঋতুতে প্রজননে অংশ নেয়া মাছ সরিয়ে নিয়ে অন্য একটি এ্যাকুয়ারিয়ামে ভালভাবে খাবার দিলে এবং যত্ন নিলে ৭-১০ দিনের মধ্যে পুনরায় ডিম দেয়ার উপযুক্ত হয়ে থাকে।  প্রজনন এ্যাকুয়ারিয়ামে এক রাত থাকার পরও যদি মাছ প্রজনন না করে থাকে তবে মাছ দুটিকে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং কয়েক দিন ভালো করে খাইয়ে আবার প্রজনন এ্যাকুয়ারিয়ামে দিতে হবে। 



ডিমের সংখ্যা:  ডিমের সংখ্যা নির্ভর করে মাছের বয়স, আকৃতি,শরীরের সুস্থতা ও নিয়মিত পরিচর্যার উপর। বেশী বয়স্ক মাছের ডিম দেবার হার অল্প বয়স্ক মাছের থেকে তুলনামূলক ভাবে কম হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক পরিবেশে গোল্ড ফিশের ডিম দেবার হার প্রতি প্রজননে ২০০০-৪০০০ ডিম। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এর ডিম দেবার হার গোনাড প্রতি ২৩৪৭±৩০২.২ ডিম বা প্রতি গ্রাম দেহ ওজনের প্রেক্ষিতে ৬৩.৪৪ ডিম। এই লেখায় উপস্থাপিত পদ্ধতিতে প্রতি প্রজননে গোল্ডফিশের ১০০ থেকে ২০০ টি পোনা পাওয়া সম্ভব হয়েছে।  




ডিমের পরিচর্যা:  অনেকে ডিমের এ্যাকুয়ারিয়ামে মিথাইলিন ব্লু ব্যাবহার করে থাকেন। ১% মিথাইলিন ব্লু ১ ফোটা দিলেই যথেষ্ট। মিথাইলিন ব্লু পানিকে অন্ধকার করে এবং ডিমকে ছত্রাকের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে থাকে, পানিতে বিভিন্ন পরজীবীর বৃদ্ধিকে রোহিত করে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও আলো থেকে অবশ্যই ডিমকে দূরে রাখতে হবে। আলো বেশী থাকলে কোন কাপড় দিয়ে দিনের বেলা এ্যাকুয়ারিয়ামকে ঢেকে রাখা যায়। তবে বাতাস চলাচলের মত ফাকা রাখতে হবে এবং যেন একেবারে অন্ধকার না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।  



ডিমের রং: গোল্ড ফিশের ডিমের রং হবার পরপরই একদম স্বচ্ছ হয়ে থাকে,পরে আস্তে আস্তে ডিম কিছুটা স্বচ্ছ সাদাটে হয়। প্রাথমিক অবস্থায় পানিতে ভাল ভাবে খেয়াল না করলে ডিম বোঝা যায় না। সময় যাবার সাথে সাথে যে সব ডিম নষ্ট হয়ে যায় তাদের রং কাল হয় এবং অনেক সময় ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চারিদিকে তুলার মত আবরণ তৈরি করে।  ডিম থেকে পোনা ফুটে বের হওয়া: সাধারণত ৩-৫ দিনের মধ্যেই ডিম ফুটে পোনা বের হয়ে আসে। তাপমাত্রা অনুযায়ী সময় কম বেশী লাগে। ডিম ফোটার পর পোনা ১-২ দিন এ্যাকুয়ারিয়ামের দেয়ালের গায়ে লেগে থাকে। খালি চোখেই পোনা দেখা যায়।  



পোনার খাবার: পোনা ফুটে ৭২ ঘণ্টা পার হলে খাবার দিতে হয়। কারণ প্রথম ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত পোনা মাছ তার দেহস্থ কুসুম থলি থেকেই পুষ্টি পেয়ে থাকে। ৭২ ঘণ্টা পর খাবার হিসেবে কেবল ফুটানো আর্টিমিয়া ও সিদ্ধ ডিমের কুসুম ছেকে দিতে হবে। আস্তে আস্তে পোনা বড় হবে এবং খাবারের প্রোটিনের পরিমাণ কমাতে হবে। ছোট অবস্থায় খাবারের প্রোটিনের পরিমাণ বেশী হতে হয়। বড় পোনাকে টিউবিফ্যাক্স দেয়া যায়। তবে তা কুঁচি করে দেয়াই ভাল। পোনা মাছকে দিনে দুইবার খাবার দিতে হবে (সকাল ও বিকাল)।  পরবর্তী দেড় থেকে দুই বছরে পোনা বড় হয়ে প্রজননের জন্য উপযুক্ত হয়।  



যা অবশই করতে হবে:  স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে অবশ্যই আলাদা স্থানে রেখে যত্ন নিতে হবে। মাছকে প্রজননের আগে ও পরে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। প্রজনন বক্স তৈরির সময় ছেড়া নেট ব্যাবহার করা যাবে না। এতে করে মাছ ছেড়া অংশ দিয়ে বের হবার চেষ্টা করবে এবং আহত হবে । ডিম দেবার পর বের হয়ে ডিম খেয়ে ফেলবে। নেটের তারে ও জালে রং ব্যবহার করতে হবে এতে করে জাল পানি থেকে রক্ষা পাবে এবং লোহার তারে মরিচা ধরবে না এর ফলে পানির পি,এইচ এর কোন পরিবর্তন হবে না। ব্যবহৃত রং ভাল ভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। বাক্সের উপরের চার কোনায় অতিরিক্ত তার রাখতে হবে যাতে করে সহজেই বাক্সটিকে এ্যাকুয়ারিয়ামের ভেতরে ঝুলিয়ে দেয়া যায়। ডিম নিষিক্ত হয়েছে নিশ্চিত হবার সাথে সাথে স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে আলাদা করতে হবে।